দেনমোহর পরিশোধের নিয়ম জেনে নিন

বিবাহ ইসলামী জীবনযাত্রার একটি পবিত্র অংশ এবং এটি একটি পারিবারিক বন্ধন গড়ে তোলে, যা স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে সুদৃঢ় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করে। এই সম্পর্কের মূল ভিত্তি হলো দায়িত্বশীলতা, ভালোবাসা এবং পারস্পরিক সম্মান। ইসলামী বিবাহের প্রক্রিয়ায় "দেনমোহর" একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি এক ধরনের আর্থিক প্রতিশ্রুতি, যা স্বামীকে স্ত্রীর প্রতি প্রদান করতে হয় এবং এটি ইসলামে বাধ্যতামূলক।

কিন্তু অনেকেই এই দেনমোহরের সঠিক অর্থ, তা নির্ধারণ এবং পরিশোধের নিয়ম সম্পর্কে জানেন না। আজকে আমরা ইসলামী আইনে দেনমোহরের ভূমিকা, তা নির্ধারণের পদ্ধতি, পরিশোধের নিয়ম এবং দেনমোহর সম্পর্কিত বিভিন্ন আইনগত ও সামাজিক বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো। আশা করি ধৈর্য ধারণ করে আপনারা লেখাটি মনোযোগ সহকারে পড়বেন ।

দেনমোহর কী?

দেনমোহর হলো সেই সম্পদ বা অর্থ, যা ইসলামী বিবাহের সময় স্বামী তার স্ত্রীকে প্রদান করেন বা প্রদান করার প্রতিশ্রুতি দেন। এটি স্ত্রীর অধিকার এবং স্বামীর ওপর একটি বাধ্যবাধকতা। কোরআন ও হাদিস অনুযায়ী, দেনমোহর নারীর প্রতি সম্মান এবং বিবাহের গুরুত্বের প্রতীক। এটি নারীর আর্থিক সুরক্ষাও নিশ্চিত করে।

দেনমোহর পরিশোধের নিয়ম


কোরআন শরীফে আল্লাহ তায়ালা বলেন:

"এবং তাদের (স্ত্রীদের) জন্য দেনমোহর নির্ধারিতভাবে প্রদান করো, স্বতঃস্ফূর্তভাবে।"
(সূরা নিসা: ৪)

এই আয়াতের মাধ্যমে বোঝা যায় যে, দেনমোহর কোনো শর্তযুক্ত উপহার নয়, বরং এটি একটি ধর্মীয় ও আইনগত অধিকার।

দেনমোহর নির্ধারণের নিয়ম

দেনমোহর নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে ইসলামী আইনে কিছু নিয়ম এবং শর্তাবলী রয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর আর্থিক অবস্থা, সামাজিক প্রেক্ষাপট, এবং পারিবারিক প্রথা এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে দেনমোহরের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। সাধারণত, দেনমোহর নিয়ে আলোচনার সময় পরিবারের বড়রা বা অভিভাবকরা বিবাহের পূর্বে এটি নিয়ে আলোচনা করেন এবং উভয় পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে দেনমোহর নির্ধারিত  করেন।

১. দেনমোহরের পরিমাণের সীমা

ইসলামে দেনমোহরের নির্দিষ্ট কোনো সর্বনিম্ন বা সর্বোচ্চ সীমা নেই। তবে, এটি এমন হতে হবে যা স্বামী দিতে সক্ষম হন এবং স্ত্রীও তা গ্রহণে সম্মত থাকেন। অনেকে "মহর ফাতিমি" নামক একটি পরিমাপ অনুসরণ করেন, যা হযরত ফাতিমা (রা.) এর দেনমোহর হিসেবে নির্ধারিত ছিল। তবে এটি বাধ্যতামূলক নয়, বরং একটি রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

২. দেনমোহরের দুই ভাগ: মোহরান্দাজিল ও মোহরমুয়াজ্জাল

দেনমোহর মূলত দুটি ভাগে বিভক্ত করা যায়:

  • মোহরান্দাজিল: যা বিয়ের সময় বা বিয়ের আগে পরিশোধ করতে হয়। এটি অবিলম্বে পরিশোধযোগ্য দেনমোহর।

  • মোহরমুয়াজ্জাল: যা স্বামী একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর বা স্ত্রীর দাবি করার সময় পরিশোধ করতে বাধ্য থাকেন। এটি স্থগিত রাখা যায়, কিন্তু স্ত্রীর চাহিদায় যে কোনো সময় পরিশোধ করতে হবে।

৩. দেনমোহর আলোচনা

বিয়ের সময় দেনমোহর নিয়ে আলোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই আলোচনা হওয়ার সময় স্বামী-স্ত্রী এবং তাদের পরিবার যেন উভয়ের আর্থিক সক্ষমতা এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেন। অনেকে অস্বাভাবিকভাবে বড় অঙ্কের দেনমোহর নির্ধারণ করে, যা স্বামী পরিশোধ করতে অক্ষম হন। এটি পরবর্তীতে বিবাহিত জীবনে ঝামেলা সৃষ্টি করতে পারে, তাই দায়িত্বশীলভাবে এই আলোচনা করা উচিত।

দেনমোহর পরিশোধের নিয়ম

দেনমোহর পরিশোধের ক্ষেত্রে ইসলামে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। স্বামীর উপর বাধ্যতামূলকভাবে স্ত্রীর দেনমোহর পরিশোধ করতে হয়, তা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। দেনমোহর পরিশোধের কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম নিচে উল্লেখ করা হলো:

১. স্ত্রী যখনই দাবি করবেন, স্বামীকে তখনই পরিশোধ করতে হবে

দেনমোহর মূলত স্ত্রীর অধিকার এবং তিনি যখনই চান, তখন তা দাবি করতে পারেন। স্বামীর উচিত স্ত্রীর দাবির পর দেনমোহর পরিশোধ করা, তা সময় মতো না করলে এটি ইসলামী আইনে দোষ হিসেবে গণ্য হয়।

২. দেনমোহর লিখিতভাবে উল্লেখ করা

বিয়ের সময় দেনমোহরের পরিমাণ লিখিতভাবে বিবাহ চুক্তিতে (নিকাহনামা) উল্লেখ করা হয়। এটি আইনি প্রমাণ হিসেবে কাজ করে এবং উভয়ের মধ্যে পরবর্তীতে কোনো বিরোধ বা ভুল বোঝাবুঝি এড়াতে সহায়ক হয়।

৩. দেনমোহর স্থগিত রাখার শর্ত

অনেক ক্ষেত্রে, মোহরমুয়াজ্জাল বা স্থগিত দেনমোহর পরে পরিশোধ করা যায়। তবে, যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তালাক বা বিচ্ছেদ ঘটে, তাহলে স্বামীকে অবিলম্বে মোহরমুয়াজ্জাল দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে।

৪. দেনমোহর সম্পত্তি আকারে দেওয়া

দেনমোহর শুধু নগদ অর্থ আকারে নয়, স্বর্ণালঙ্কার, জমি, বাড়ি, অথবা অন্য কোনো সম্পত্তি হিসেবেও হতে পারে। তবে যাই প্রদান করা হোক না কেন, তা স্ত্রীর নামে নথিভুক্ত এবং তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হবে।

কিস্তিতে দেনমোহর পরিশোধের নিয়ম

ইসলামী বিবাহে দেনমোহর একটি বাধ্যতামূলক আর্থিক প্রতিশ্রুতি, যা স্বামীকে তার স্ত্রীকে প্রদান করতে হয়। অনেক সময় স্বামী দেনমোহরের পুরো পরিমাণ একসঙ্গে পরিশোধ করতে অক্ষম হন, তাই দেনমোহর কিস্তিতে পরিশোধ করার বিকল্প থাকতে পারে। ইসলামী আইন অনুযায়ী কিস্তিতে দেনমোহর পরিশোধ করা বৈধ, তবে এর জন্য কিছু নিয়ম ও শর্ত মেনে চলা উচিত।

কিস্তিতে দেনমোহর পরিশোধের বৈধতা

ইসলামী শরিয়া অনুযায়ী, স্বামী এবং স্ত্রী যদি সম্মত হন, তাহলে দেনমোহর কিস্তিতে পরিশোধ করা যেতে পারে। এতে উভয়ের আর্থিক সুবিধা হয় এবং স্বামী দেনমোহরের চাপ এড়িয়ে কিস্তির মাধ্যমে ধীরে ধীরে পরিশোধ করতে পারেন। কিস্তির ব্যবস্থা সাধারণত স্ত্রীর সম্মতির ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় এবং তা নিকাহনামা বা বিবাহ চুক্তিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হয়।

কিস্তিতে দেনমোহর পরিশোধের জন্য কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলা উচিত, যা উভয় পক্ষের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে। এগুলো হলো:

১. পারস্পরিক সম্মতি

কিস্তিতে দেনমোহর পরিশোধ করার জন্য স্বামী এবং স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক সম্মতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্ত্রী যদি সম্মত না হন, তাহলে স্বামীকে তা এককালীন পরিশোধ করতে হবে। কিস্তিতে পরিশোধের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় উভয়কে আর্থিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

২. নিকাহনামায় উল্লেখ করা

দেনমোহর কিস্তিতে পরিশোধ করা হবে, তা নিকাহনামায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা উচিত। এতে পরবর্তীতে কোনো ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনা থাকে না এবং আইনি প্রমাণ হিসেবে এটি কাজ করে। কিস্তির সংখ্যা, পরিমাণ এবং সময়সীমা নির্ধারণ করা উচিত, যা উভয়ের সম্মতিতে লেখা হবে।

৩. কিস্তির পরিমাণ এবং সময়সীমা নির্ধারণ

কিস্তিতে দেনমোহর পরিশোধের সময় কিস্তির পরিমাণ এবং সময়সীমা নির্ধারণ করতে হবে। এটি স্বামীর আয়ের উপর নির্ভর করে স্থির করা যেতে পারে, যাতে তিনি ধীরে ধীরে কিস্তি পরিশোধ করতে পারেন। সময়মতো কিস্তি পরিশোধ করা স্বামীর জন্য বাধ্যতামূলক, এবং স্ত্রীর অধিকার রয়েছে সময়মতো কিস্তি না দিলে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার।

৪. কিস্তি পরিশোধ না করার শাস্তি

যদি স্বামী সময়মতো কিস্তি পরিশোধ করতে ব্যর্থ হন বা ইচ্ছাকৃতভাবে দেনমোহর কিস্তি বন্ধ করে দেন, তবে স্ত্রী তার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে পারেন। অনেক দেশে পারিবারিক আদালতে স্ত্রীরা দেনমোহর আদায়ের জন্য মামলা করতে পারেন এবং আদালত স্বামীকে বাধ্যতামূলকভাবে কিস্তি পরিশোধ করতে নির্দেশ দিতে পারে।

কিস্তিতে দেনমোহর পরিশোধের সুবিধা

কিস্তিতে দেনমোহর পরিশোধের কিছু সুবিধা রয়েছে, যা স্বামী-স্ত্রীর আর্থিক স্থিতি এবং বিবাহের স্থায়িত্ব রক্ষা করতে সাহায্য করে:

১. আর্থিক চাপ কমানো

দেনমোহর এককালীন পরিশোধের পরিবর্তে কিস্তিতে পরিশোধ করলে স্বামীর উপর আর্থিক চাপ কমে। বিশেষ করে যেসব স্বামী এককালীন বড় অঙ্কের দেনমোহর পরিশোধ করতে অক্ষম, তাদের জন্য এটি একটি উপযুক্ত সমাধান।

২. পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়ন

কিস্তিতে দেনমোহর পরিশোধের ব্যবস্থা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করতে পারে। এটি উভয়কে আর্থিকভাবে স্থিতিশীল থাকার সুযোগ দেয় এবং বিবাহিত জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

৩. আইনগত সুরক্ষা

কিস্তিতে দেনমোহর পরিশোধ করলে এটি নিকাহনামায় উল্লেখিত থাকে, যা ভবিষ্যতে কোনো ঝামেলা বা বিরোধ এড়াতে সাহায্য করে। এটি আইনি সুরক্ষা দেয় এবং স্ত্রীর অধিকার সুরক্ষিত থাকে।

কিস্তিতে দেনমোহর পরিশোধ ইসলামী আইনে বৈধ এবং এটি স্বামী-স্ত্রীর আর্থিক স্থিতি এবং সম্পর্কের উন্নয়নের একটি কার্যকর উপায়। তবে, কিস্তির পরিমাণ, সময়সীমা এবং নিয়ম সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে হবে এবং তা নিকাহনামায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা উচিত।

স্বামীর জন্য সময়মতো কিস্তি পরিশোধ করা বাধ্যতামূলক, আর স্ত্রীর অধিকার রয়েছে দেনমোহর দাবির। দেনমোহর ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং এটি সঠিকভাবে পরিশোধ করা দাম্পত্য জীবনের সুস্থতা ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত করে।

তালাকের সময় দেনমোহরের ভূমিকা

তালাকের সময় দেনমোহরের বিষয়টি আরও বেশি গুরুত্ব পায়। যদি কোনো কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তালাক ঘটে, তবে স্বামীকে স্ত্রীর দেনমোহর পুরোপুরি পরিশোধ করতে হবে। দেনমোহর পরিশোধ না করা পর্যন্ত তালাকের আইনি বৈধতা সম্পূর্ণ হয় না। তালাকের সময় দেনমোহর পরিশোধ না করলে এটি স্ত্রীর আইনি অধিকার লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হয় এবং স্ত্রীর পক্ষ থেকে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ থাকে।

ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে দেনমোহরের গুরুত্ব

দেনমোহরকে শুধুমাত্র আর্থিক লেনদেন হিসেবে দেখলে এটি ভুল হবে। এটি নারীর অধিকার এবং সম্মান প্রদর্শনের প্রতীক। ইসলাম নারীর আর্থিক স্বাধীনতা এবং মর্যাদার ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করে। দেনমোহর নারীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হয় এবং স্বামী তা কোনোভাবেই হস্তক্ষেপ করতে পারেন না।

হাদিসে উল্লেখ রয়েছে:

"যে নারীকে দেনমোহর ছাড়া বিয়ে করবে, তার নিকাহ পূর্ণাঙ্গ হবে না, যতক্ষণ না দেনমোহর পরিশোধ করা হয়।"
(তিরমিজি)

এই হাদিসের মাধ্যমে বোঝা যায় যে, দেনমোহর পরিশোধ করা একটি অপরিহার্য এবং বৈধ প্রক্রিয়া, যা ইসলামী বিবাহের মূল শর্তগুলোর মধ্যে একটি।

দেনমোহর সম্পর্কিত আইন

ইসলামী আইন অনুযায়ী দেনমোহর একটি বাধ্যতামূলক অধিকার, তবে অনেক দেশে এর আইনি ভিত্তিও রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের মতো দেশে পারিবারিক আইনে দেনমোহর নিয়ে বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এসব দেশে দেনমোহর না পরিশোধের ক্ষেত্রে স্ত্রী আদালতের মাধ্যমে স্বামীর বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নিতে পারেন।

১. আদালতের মাধ্যমে দেনমোহর দাবি

স্বামী যদি দেনমোহর পরিশোধে অক্ষম হন বা তা দিতে ইচ্ছুক না হন, তবে স্ত্রী আদালতে একটি মামলা দায়ের করতে পারেন। আদালত উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে স্ত্রীর অধিকার অনুযায়ী রায় প্রদান করে এবং স্বামীকে দেনমোহর পরিশোধের নির্দেশ দেয়।

২. দেনমোহর না দিলে শাস্তি

অনেক দেশে, দেনমোহর না দিলে স্বামীকে আইনি শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়। এটি সাধারণত আর্থিক জরিমানা অথবা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার মতো শাস্তি হতে পারে।

দেনমোহর সম্পর্কিত কিছু সাধারণ ভুল ধারণা

দেনমোহর নিয়ে অনেকের মধ্যে কিছু ভুল ধারণা রয়েছে, যা সম্পর্কে সচেতন হওয়া জরুরি। নিচে কয়েকটি ভুল ধারণা এবং তার বাস্তবতা উল্লেখ করা হলো:

১. "দেনমোহর শুধু প্রতীকী, এটি পরিশোধ করতে হয় না।"

এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। দেনমোহর কোনো প্রতীকী উপহার নয়, এটি স্ত্রীর অধিকার এবং স্বামীকে অবশ্যই তা পরিশোধ করতে হয়।

২. "তালাক ছাড়া দেনমোহর প্রয়োজন হয় না।"

তালাক ছাড়াও, স্ত্রী যখনই চান, তখনই দেনমোহর দাবি করতে পারেন। এটি তার অধিকার এবং এটি দিতে বিলম্ব করা বা এড়ানো শরিয়তসম্মত নয়।

৩. "স্বামী যদি দেনমোহর না দেয়, তাহলে তাতে কোনো সমস্যা নেই।"

দেনমোহর না দিলে এটি ইসলামী এবং আইনি উভয় ক্ষেত্রেই অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। স্ত্রী তার অধিকার চাইলে স্বামীকে অবশ্যই তা প্রদান করতে হবে।

প্রশ্নোত্তর পর্ব 

ইসলামে সর্বনিম্ন দেনমোহর কত টাকা?

ইসলামে সর্বনিম্ন দেনমোহরের নির্দিষ্ট কোনো পরিমাণ নেই। কোরআন ও হাদিসে দেনমোহরের সর্বনিম্ন বা সর্বোচ্চ কোনো নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ করা হয়নি। তবে, দেনমোহরের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় স্বামী-স্ত্রীর আর্থিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে এবং এটি উভয় পক্ষের সম্মতির ওপর নির্ভরশীল।

তবে, কিছু ইসলামী প্রথায় "মহর ফাতিমি" অনুসরণ করা হয়, যা হযরত ফাতিমা (রা.) এর দেনমোহর ছিল। এটি একটি ঐতিহ্যবাহী মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু বাধ্যতামূলক নয়। বিভিন্ন অঞ্চলে সমাজের প্রচলিত প্রথা অনুসারে ন্যূনতম পরিমাণ নির্ধারণ করা হতে পারে।

দেনমোহর কিভাবে নির্ধারণ করা হয়?

দেনমোহর নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে ইসলামে কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই, তবে তা স্বামী-স্ত্রীর আর্থিক ক্ষমতা এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়। বিয়ের সময় স্বামী এবং স্ত্রীর মধ্যে দেনমোহরের বিষয়ে আলোচনা করা হয় এবং দুই পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে পরিমাণ স্থির হয়।

দেনমোহর দুই ধরণের হতে পারে:

  • মোহরান্দাজিল: যা বিয়ের সময় বা তার আগে অবিলম্বে প্রদান করতে হয়।

  • মোহরমুয়াজ্জাল: যা একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর বা স্ত্রীর দাবি অনুযায়ী পরিশোধ করতে হয়।

দেনমোহর সম্পত্তি, অর্থ বা স্বর্ণালঙ্কার আকারেও নির্ধারিত হতে পারে, যা স্ত্রীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হয়।

মেয়ে নিজে তালাক দিলে কি দেনমোহর পাবে?

যদি স্ত্রী নিজে তালাকের জন্য আবেদন করেন এবং তালাক হয়, তবে তিনি দেনমোহর পাওয়ার অধিকার রাখেন। ইসলামে, দেনমোহর স্ত্রীর অধিকার এবং তালাকের আগে বা পরে, তিনি তার দেনমোহর দাবি করতে পারেন।

তবে, যদি স্ত্রী খুলা (স্বামীকে তালাকের বিনিময়ে দেনমোহর ছেড়ে দেওয়া) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তালাক চান, তাহলে তিনি দেনমোহর নাও পেতে পারেন। খুলার সময় স্ত্রীর দেনমোহর ছেড়ে দেওয়া বা আংশিক ছাড় দেওয়া একটি শর্ত হতে পারে, যা উভয় পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে স্থির হয়।

দেনমোহর মামলার শাস্তি কি?

স্বামী যদি দেনমোহর পরিশোধ করতে ব্যর্থ হন বা ইচ্ছাকৃতভাবে তা না দেন, তাহলে স্ত্রী আদালতে দেনমোহর দাবির জন্য মামলা করতে পারেন। আদালত সাধারণত স্বামীর আর্থিক অবস্থার বিবেচনায় স্বামীকে দেনমোহর পরিশোধের আদেশ দেয়।

দেনমোহর মামলায় যদি আদালত স্বামীকে দেনমোহর পরিশোধের নির্দেশ দেন এবং তিনি তা না মানেন, তাহলে আদালত তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। এই শাস্তি হতে পারে:

  • আর্থিক জরিমানা

  • সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা

  • জেলে প্রেরণ করার মতো শাস্তি নির্ধারণ করা

দেনমোহর মামলায় আদালতের নির্দেশ অমান্য করা আইনি লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হয়, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

আমাদের শেষ কথা- দেনমোহর পরিশোধের নিয়ম

দেনমোহর ইসলামী বিবাহের একটি অপরিহার্য অংশ এবং এটি নারীর অধিকার সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেনমোহর শুধুমাত্র একটি আর্থিক লেনদেন নয়, এটি নারীর মর্যাদা, আর্থিক সুরক্ষা এবং তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের প্রতীক।

দেনমোহর নিয়ে সঠিক জ্ঞান এবং এর নিয়মাবলী মেনে চলা স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম যেভাবে দেনমোহরকে নারীর অধিকার হিসেবে নির্ধারণ করেছে, তা বুঝে এবং সম্মানের সঙ্গে পালন করা একটি আদর্শ পারিবারিক জীবন গড়ে তুলতে সাহায্য করে।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url